BLOG: Uncollected Ghanada

অগ্রন্থিত অসম্পূর্ণ কাহিনি ‘মহাভারতে ঘনাদা’-র শীর্ষচিত্র । শিল্পী : জনৈক ‘স্বপন’ বাবু ।

এই অগ্রন্থিত অসম্পূর্ণ ঘনাদা-গল্পটি খুঁজে পাওয়ার কৃতিত্ব শ্রী সমুদ্র বসু-র প্রাপ্য ।
তরুণ এই আর্কাইভিস্ট, পেশায় বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কনসালটেন্ট ।
অক্লান্তভাবে উনি শিশু-কিশোর সাহিত্যের প্রাচীন / নতুন লেখকদের রচনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে চলেছেন ।
সমুদ্র বাবু-র সৌজন্যে, তাঁর পুনরাবিষ্কৃত প্রেমেন্দ্র মিত্র-র এই অজানা কাহিনি সম্পর্কে জানা গেল ।

দাস-এর শ্রোতা ছিল লেকের ধারটিতে,
ঘনা-র শ্রোতা মেস-কোণে …

এ যেন পিঞ্জর-পক্ষী আর বন-বিহঙ্গ ।
হচ্ছে ঘনশ্যাম দাস মহাশয়ের দুই শ্রেণির শ্রোতার কথা ।

অপরাহ্ণ ।
শহরের দক্ষিণে অবস্থিত এক কৃত্রিম জলাশয়ের পাড়ে প্রতীক্ষমাণ প্রৌঢ়-চতুষ্টয় ।
রামশরণ, শিবপদ, হরিসাধন, ভবতারণ ।
কখন কানে আসবে তাঁর ছড়ির ঠুক ঠুক ?
সেই কথক, যাঁর পূর্বপুরুষের কাহিনির আঠায় জুড়ে যাবে হিস্ট্রির কত হারানো লিঙ্ক ।
লেকের আড্ডার ঘনশ্যাম বাবু ।

ঘনাদা-র মেস-মহলের তরুণ শ্রোতাগণ । শিল্পী : প্রতুল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ।

পরদিন তাঁকেই পাবেন ঘনাদা রূপে ।
মেসের আর্মচেয়ারে আরামে আসীন ।
সেখানে সুখাদ্যের সুরভির সঙ্গে মিলবে বিজ্ঞানের সুবাস । ইতিহাসের বদলে ।
তস্য তস্য নয় । তাঁর নিজেরই কোন অতীত অভিযানের বর্ণনায় ।
এসব কিসসা বয়স্কদের মাঝে চালানো চলে না ।
মেসের ঘনাদা-র চার শ্রোতা তাই যুবক ।
শিবু, শিশির, গৌর, সুধীর ।

একই কথকের দ্বিবিধ সত্তা ।
দু’ধরনের গল্প ।
দুটি লোকেশন ।
দু’রকম শ্রোতা ।

আচ্ছা, মেস-মহলের মাতব্বরগণ কি সরোবর-সভার সদস্যদের চিনতেন ?
নামটুকুও জানতেন ?

তাঁর ষষ্ঠ গল্প ‘ছড়ি’ (১৯৪৯) ।
ঘনাদা যে লেকের ধারে ঐ ছড়ি সহযোগে সান্ধ্যভ্রমণ সারেন, এই গল্পেই হয়ত ১ তার পয়লা উল্লেখ ।
অর্থাৎ ৭২ বনমালী নস্কর লেন-এর ছেলেদের কাছে তাঁর বৈকালিক গন্তব্যস্থল অজানা ছিল না ।
ঐটুকুই ।
কিন্তু ধরা যাক, মেসের শিবু । তিনি কি লেকের শিবপদ বাবুর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন ?
‘ঘনাদা সমগ্র’ ঘেঁটেও এমন প্রমাণ পাওয়া দুষ্কর ।

মিলল অবশেষে ।

১৯৭৮ সালে বেরয় ‘তেল দেবেন ঘনাদা’ ।
১৯৮০-র পুজোয় ‘জ্য়দ্রথ বধে ঘনাদা’ ।
এরই ফাঁকে ১৩৮৭ সনের বৈশাখ মাসে প্রেমেন্দ্র মিত্র শুরু করেন একটি নতুন ঘনাদা ধারাবাহিক ।
অদ্যাবধি যা অগ্রন্থিত ।
অধুনালুপ্ত ‘ঝলমল’ পত্রিকায় প্রকাশিত সেই ‘মহাভারতে ঘনাদা ’-র কথাই বলছি ।

ইতিমধ্যে ১৯৬৮-তে সমাপ্ত হয়েছে ঘনশ্যাম বাবু বর্ণিত শেষ তস্য তস্য কাহিনি ‘সূর্য কাঁদলে সোনা’ ২ ।
ঘনাদা-র অভিনব মহাভারত চর্চাও চালু হয়ে গেছে ৩ ।
পরে, সেই পর্যায়ের আটখানি গল্প যে পুস্তকে একত্রিত হল, তার নামও ‘মহাভারতে ঘনাদা’ ৪ ।
সেই বইখানির সঙ্গে অবশ্য গ্রন্থবদ্ধ না-হওয়া আলোচ্য ধারাবাহিক ‘মহাভারতে ঘনাদা’-র কোন সম্পর্ক নেই ।
খোদ মহাভারত-এর সঙ্গেই কি থাকবার কথা ছিল ?

জানা সম্ভব নয় ।
কারণ মাত্র ছ’টি কিস্তিতে বিন্যস্ত ‘মহাভারতে ঘনাদা’ অসম্পূর্ণ রচনা ।
তাতে অবশ্য এর অভিনবত্ব হ্রাস পায় না ।

একমাত্র এই গল্পে দুই দল শ্রোতার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছে । গোড়া থেকেই ।
স্বয়ং ঘনশ্যাম বাবু-ই তাঁর বয়স্ক বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছেন বনমালী নস্কর-এ ।
উদ্দেশ্য, মেস-মহলের সঙ্গে সরোবর-সভার মিলন ।
জানা গেল, ইতিমধ্যে ঘনাদা-র বর্ণনা থেকে লেকের প্রবীণদের নাম, চেহারা, পেশা সবই মেসবাসীদের মুখস্থ ।
মুখোমুখি হওয়াটুকুই বাকি ।

ভবিষ্যতে পরাশর বর্মা-র সঙ্গে ঘনশ্যাম দাস-এর মোলাকাতের সাক্ষী থাকবে ৭২ নম্বর ৫ ।
এও যেন অনুরূপ এক ঐতিহাসিক মিটিং-এর তোড়জোড় …

ঘনাদা-র সবজান্তা ভক্তদেরও ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ানোর মত কিছু ‘ট্রিভিয়া’ ছড়িয়ে আছে ‘মহাভারতে ঘনাদা’-য় ।
মেদভারে হস্তীসদৃশ ভবতারণ বাবু-কে তো চিনি ।
কিন্তু তাঁর পুত্র যে মস্ত ডেকোরেটর-এর কারবার চালান, জানা ছিল কি ?

কিংবা, মেসের নিকটস্থ বড় রাস্তার যে মিষ্টান্ন-প্রস্তুতকারক নিয়মিত ঘনাদা-কে মিঠাই সাপ্লাই করে থাকেন, তাঁর নাম রাধেশ্যাম ওরফে রাধু ।
প্রয়োজনে তাঁর দোকানের ফোনটি স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করা চলে ।
৭২ নম্বরে দূরভাষ যন্ত্র নেই যে ।

ঘনাদা-র ঘর তেতলায় ।
বৃষ্টি পড়লে ন্যাড়া ছাদ পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলেই ভেজবার ভয় ।
টঙের ঘরের বাসিন্দা তাই একবার ফরমান জারি করেন ।
বর্ষাকালে ঐ ছাদ আর সিঁড়ি ম্যারাপ বেঁধে তেরপল দিয়ে ঢেকে দিতে হবে ।
জানতেন কি ?

বনমালী নস্কর লেন-এর চার শ্রোতার নামকরণ, প্রেমেন্দ্র মিত্র-রই বন্ধুদের অনুসরণে ।

‘ঘড়ি’ ও ‘ঘনাদার ধনুর্ভঙ্গ’ গল্পে শিবু / শিবরাম । শিল্পী : শৈল চক্রবর্তী ।‘ঘড়ি’ ও ‘ঘনাদার ধনুর্ভঙ্গ’ গল্পে শিবু / শিবরাম । শিল্পী : শৈল চক্রবর্তী ।

 

এ-খবর তো পুরনো ৬ ।
‘ঘনাদা গ্যালারি’ ওয়েবসাইটে ৭ সাজানো অলংকরণেও রয়েছে সেই ছাপ ।
চোখ রাখুন ‘ঘড়ি’ ৮ (১৯৪৮) ও ‘ঘনাদার ধনুর্ভঙ্গ’ ৯ (১৯৭০) গল্পের শীর্ষচিত্রে ।
শিবু-কে যথার্থই আঁকা হয়েছে শিব্রামীয় আদলে ।
অদ্বিতীয় ঐ কেশবিন্যাসই তার প্রমাণ ।
শিল্পী ? স্বয়ং শৈল চক্রবর্তী । বলাই বাহুল্য ।

‘মহাভারতে ঘনাদা’ গল্পে দেখছি সেই শিবু আর শিবরাম একেবারে একাত্ম ।
শিবরাম চক্রবর্তী-কে তাঁর জন্মসাল জিজ্ঞেস করলে বহুবিধ উত্তর মিলেছে ।
তাঁর তৎকালীন মর্জি অনুসারে ।
সিপাই বিদ্রোহের বছরটিও বাদ পড়েনি !
এ-ব্যাপারে তিনি যেন ঘনাদারই সমতুল ।
আলোচ্য গল্পে দেখা যাচ্ছে, শিবু-র ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনও একটা নয়, অনেক ।
১২ ই জুলাই, ৭ ই আগস্ট – যা খুশি হতে পারে ।
কোন্ আত্মীয়ের কাছ থেকে কোন্ তারিখে জন্মদিনের উপহার আদায় করতে হবে, তাও লিখে রেখেছেন শিবু ।
কোথায় ?
কেন ? রাজ্যের দরকারি ফোন নম্বর / ঠিকানা যেখানে লিপিবদ্ধ ।
মেস-ঘরের প্রাচীর-গাত্রে !
কে না জানে, এই অভ্যাস ছিল খোদ চক্রবর্তী মহাশয়ের ।
বনমালী নস্কর লেন – মুক্তারামবাবু স্ট্রীট এখানে মিলে একাকার ।
এমনটা আগে হয়েছে কি ?

‘মহাভারতে ঘনাদা’-র যে কিস্তিতে শিবু-র এই কীর্তি ফাঁস করেছেন লেখক ‘সুধীর’, তার প্রকাশ, ১৩৮৭ সনের ভাদ্র সংখ্যায় ।
অর্থাৎ আগস্ট ১৯৮০ । অসমাপ্ত ধারাবাহিকের এটিই শেষ প্রকাশিত কিস্তি ।
ঐ মাসেই প্রয়াত হন শিবরাম । ২৮ তারিখে ।

পরের বছর তাই নিয়ম ভেঙে দেব সাহিত্য কুটীর বার্ষিকী-তে তিনি গরহাজির ।

এমনকি ঘনাদা-ও !

‘শিবরামের কাছে ধার’, প্রেমেন্দ্র মিত্র । শিল্পী : নারায়ণ দেবনাথ ।

পরিবর্তে স্থান পেল ‘শিবরামের কাছে ধার’ শীর্ষক একটি গল্প ১০ ।

এটিও অগ্রন্থিত ।

লেখক ?
শিব্রাম-এর সেই প্রকৃত ‘মিত্র’ ।
প্রেমেন্দ্র ।

আসল কথাই বাদ পড়েছে ।
‘মহাভারতে ঘনাদা’-র যেটুকু পাওয়া গেল, তাতে নায়ক কিন্তু তখনও অনুপস্থিত ।
ঘনাদা-র উল্লেখ অবশ্যই আছে । তবে ফ্ল্যাশব্যাকে ।
বর্তমানে তিনি নতুন কোন্ কিসসা ফেঁদে বসবেন ?
বিজ্ঞান-সুবাসিত না ইতিহাস-আশ্রিত ?
নাকি মহাভারত-নির্ভর ?
কাহিনি-শিরোনামটুকু ছাড়া তার কোনো আভাসই মেলে না ।

সর্বোপরি, মেস-মহলের সঙ্গে সরোবর-সভার সেই বহু-প্রতীক্ষিত মিলন কি আদৌ ঘটত শেষ পর্যন্ত ?
জানা নেই ।

ঘনাদা-গল্পের এই অচেনা মোড়ে দাঁড়িয়ে আমরা অসহায় …

এই অগ্রন্থিত কাহিনির হেডপীসটিও, এর পুনরাবিষ্কর্তা শ্রী সমুদ্র বসু-র সৌজন্যে প্রাপ্ত ।

অসম্পূর্ণ ‘মহাভারতে ঘনাদা’ ধারাবাহিকের বাদবাকি না-দেখা চিত্রগুচ্ছ মিলবে ‘ঘনাদা গ্যালারি’ ওয়েবসাইটে :
http://ghanada.wixsite.com/ghanada-gallery/mahabharatey-ghanada

সেগুলির জন্য আমরা শ্রী সুজিত কুণ্ডু এবং শ্রী সোমনাথ দাশগুপ্ত-র কাছেও ঋণী ।

 ‘হয়ত’ বলার কারণ আছে ।
সরোবর-সিরিজের প্রথম কাহিনি ‘রবিনসন ক্রুশো মেয়ে ছিলেন’ ।
‘প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প’ গ্রন্থে (১৯৫২) অন্তর্ভুক্ত হলেও, কবে, কোন্ পত্রিকায় এর প্রথম আবির্ভাব তা স্পষ্ট নয় ।
যদি তা ১৯৪৯ বা তার আগেই লেখা হয়ে থাকে, তবে হয়ত ‘ছড়ি’-র পরিবর্তে এতেই প্রথম পাওয়া গেছে লেক-আড্ডার উল্লেখ ।


 ‘তস্য তস্য অথবা সূর্য কাঁদলে সোনা’ নামে প্রথম ধারাবাহিক প্রকাশ সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকা-য় (১১ ই শ্রাবণ ১৩৭৪ থেকে ৬ই অগ্রহায়ণ  ১৩৭৫) ।

 ‘শান্তি পর্বে ঘনাদা’ (১৯৭৪) দিয়ে ঘনাদা-র মহাভারত-পর্যায়ের সূচনা । 
দ্রষ্টব্য : http://ghanada.wixsite.com/ghanada-gallery/short-stories-from-the-1970s-ii

 ‘মহাভারতে ঘনাদা’ (২০০৩) সংকলনটি শৈব্যা প্রকাশন বিভাগ-এর ।

এর সঙ্গে কিন্তু আলোচ্য অগ্রন্থিত ধারাবাহিক ‘মহাভারতে ঘনাদা’-র কোন সম্পর্ক নেই ।

 ‘পরাশরে ঘনাদায়’ (প্রথম প্রকাশ অজ্ঞাত) এবং ‘ঘনাদা ফিরলেন’ (১৯৮৪) গল্পে প্রেমেন্দ্র মিত্র-র অপর সৃষ্টি গোয়েন্দা-কবি পরাশর বর্মা-ও উপস্থিত ।

 দ্রষ্টব্য : ভূমিকা, সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ‘ঘনাদা সমগ্র ১’, আনন্দ পাবলিশার্স ।

গৌর = গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসু, শিশির = শিশির মিত্র, শিবু = শিবরাম চক্রবর্তী, সুধীর = প্রেমেন্দ্র মিত্র-র ডাকনাম ।

 ‘ঘনাদা গ্যালারি’ ওয়েবসাইট :
http://ghanada.wix.com/ghanada-gallery

ঘনাদা গ্যালারি’ ফেসবুক পেজ :
https://www.facebook.com/GhanadaGallery/ 

৮,৯ ‘ঘনাদা গ্যালারি’ সাইটে ‘ঘড়ি’-র ছবি এই লিঙ্কে :
http://ghanada.wixsite.com/ghanada-gallery/short-stories-from-the-1940s
ঘনাদার ধনুর্ভঙ্গ’ :
http://ghanada.wixsite.com/ghanada-gallery/short-stories-from-the-1970s
 

১০ ‘বোধন’ (১৯৮১) পূজাবার্ষিকী-তে প্রকাশিত ।